আদর্শ শিক্ষক হতে হলে কি কি বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী প্রয়োজন বিস্তারিত জানুন

একজন আদর্শ শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য গুণাবলী সম্পর্কেপ্রিয় পাঠক আজকের আর্টিকেলে আমরা জানবো একজন আদর্শ শিক্ষক হতে হলে কি কি গুণাবলী থাকতে হবে। এই ব্যাপারে কিছু কথা আপনাদের সাথে শেয়ার করব। যা শিক্ষকতা করতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। আমরা জানি যিনি শিক্ষা দান করেন, তিনিই শিক্ষক। 
আদর্শ শিক্ষক হতে হলে কি কি   বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী প্রয়োজন বিস্তারিত জানুন
আমরা জানি সবাই কিন্তু আদর্শ শিক্ষক হতে পারে না। একজন আদর্শ শিক্ষকের মাঝে কি কি মৌলিক গুণাবলী থাকা প্রয়োজন সে ব্যাপারে জানা আমাদের অনেক জরুরী আর সেটাই আলোচনার মাধ্যমে আপনাদের সাথে শেয়ার করি তাহলে চলুন দেরি না করে শুরু করা যাক।

পেজ সূচিপত্রঃ আদর্শ শিক্ষক হতে হলে কি কি বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী

একজন আদর্শ শিক্ষকের পরিচয় বিবরণী

শিক্ষা বা পাঠদানের কাজে নিয়োজিত মানুষকে আমরা শিক্ষক বলেই পরিচয় দিয়ে থাকে। আনুষ্ঠানিক উপানুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক ইত্যাদি অনেক উপায়ে শিক্ষাদানের কাজ চলছে। তবে মক্তব, মাদ্রাসা, স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যারা শিক্ষাদানে জড়িত তাদেরই সাধারণত শিক্ষক বলা হয়ে থাকে। 
আদর্শ শব্দের অর্থ অনুকরণযোগ্য, শ্রেষ্ঠ, নমুনা, দৃষ্টান্ত, আয়না, দর্পণ ইত্যাদি। আদর্শ পুরুষ, যে মহৎ পুরুষের অনুকরণে চরিত্র উন্নত করা যায়। আদর্শ বিদ্যালয়, যে বিদ্যালয়ে চরিত্র গঠন ও জীবনমান উনণয়নের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে উন্নত মানের শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে।

অভিধানে আদর্শ পুরুষ ও আদর্শ বিদ্যালয়ের যে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। তার আলোকে বলব যে, আদর্শ শিক্ষক তিনি, যার অনুকরণের মাধ্যমে চরিত্র গঠন ও উন্নত করা সম্ভব। এবং জীবনের মান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে উন্নত মানের শিক্ষা অর্জন করা যায়। আর আদর্শ শিক্ষকের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। শ্রেণীকক্ষে পাঠদান। 

এবং শ্রেণীকক্ষের বাইরের জীবন। শ্রেণীকক্ষে তিনি থাকেন তার শিক্ষার্থীদের সাথে, আর শ্রেণীকক্ষের বাইরে কাটে তার ছাত্র-শিক্ষকসহ বৃহত্তর মানব সমাজের সাথে। তার বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী সর্বত্রই উত্তম হওয়া স্বাভাবিক।

যিনি সবার আদর্শ শিক্ষক সেই ব্যাপারে আল্লাহর বাণী

এই ধরণীতে সবার আদর্শ শিক্ষক হলেন আল্লাহর সর্বশেষ রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর রিসালাতের অনেক দায়িত্বের একটি অংশ ছিল শিক্ষাদান। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কালামে এরশাদ করেছেন। هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّيْنَ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيْهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوْا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِيْنٍ

তিনিই সেই সত্তা, যিনি নিরক্ষরদের মধ্যে তাদেরই একজনকে রাসূল হিসাবে পাঠিয়েছেন। যিনি তাদের নিকট তাঁর আয়াত সমূহ পাঠ করেন। ও তাদেরকে পবিত্র করেন। আর তাদেরকে কিতাব ও সুন্নাহ শিক্ষা দেন। (সুরা জুমু‘আহ আয়াত নং- ০২)

রাসূল (সাঃ) তিনি বলেছেন, وَإِنَّمَا بُعِثْتُ مُعَلِّمًا ‘আমি শিক্ষক হিসাবে প্রেরিত হয়েছি। মু‘আবিয়া বিন হাকাম আস-সুলামী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সম্পর্কে বলেন, مَا رَأَيْتُ مُعَلِّمًا قَبْلَهُ وَلاَ بَعْدَهُ أَحْسَنَ تَعْلِيمًا مِنْهُ فَوَاللهِ مَا كَهَرَنِى وَلاَ ضَرَبَنِى وَلاَ شَتَمَنِى ‘আমি তাঁর পূর্বে ও পরে তাঁর চেয়ে সুন্দর শিক্ষাদানকারী শিক্ষক আর দেখিনি। আল্লাহর কসম! তিনি আমাকে বকাবকি করেননি, মারেননি এবং গালমন্দও করেননি। 

মক্কায় আরকাম (রাঃ) এর গৃহ ছিল তাঁর শিক্ষাদান কেন্দ্র। এছাড়া কা‘বা চতবর, বিভিন্ন জনসমাবেশ ও মেলায় গিয়ে তিনি শিক্ষাদানের কাজ করতেন। মদীনায় হিজরতের পর মসজিদে নববীতে প্রতিনিয়ত শিক্ষাদানের কাজ চলত। তাঁর বহু ছাহাবীকেও তিনি শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত করেছিলেন। পুরুষ, নারী, বয়স্ক, শিশু, মুসলিম, অমুসলিম নির্বিশেষে সবাই তাঁর কাছে শিক্ষালাভ করতেন। 

তাঁর শিক্ষার বিষয় ছিল দ্বীন ইসলাম। মানুষ কিভাবে শিরক, কুফর, নিফাক, বিদ‘আত ও জাহিলিয়্যাত থেকে মুক্ত হয়ে এক আল্লাহর নির্দেশিত পথে একমাত্র তাঁর ইবাদত করতে পারে এবং দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের মুক্তি অর্জন করতে পারে তিনি সেই শিক্ষা দিতেন। মানুষের ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবন যাতে আল্লাহর দেওয়া পথে কাটানো সম্ভব হয়। 

তিনি সে সম্পর্কে শিক্ষা দিতেন। চরিত্রের ভাল ও মন্দ গুণাগুণ সম্পর্কে তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন। এবং ভাল গুণগুলো আয়ত্ব করা ও মন্দগুণ থেকে বেঁচে থাকার উপায় শিখিয়েছেন। চরিত্রকে তিনি মানুষের সবচেয়ে দামী জিনিস বলে আখ্যায়িত করেছেন।

মানবতার সবচেয়ে বড় শত্রু শয়তান, কুপ্রবৃত্তি ও কাফির নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে তিনি সবাইকে সাবধান করে গেছেন। কুরআন ছিল তাঁর শিক্ষাদানের মাধ্যম। কুরআনকে কেন্দ্র করে তাঁর শিক্ষা আবর্তিত হতো। তাঁর সে শিক্ষার সমষ্টি এখন আমরা হাদীছ রূপে পাই। যার বাস্তব অনুশীলন এখনও মুসলিমদের মধ্যে অনেকাংশে বিদ্যমান। 

যদিও আমরা বর্তমানে আমাদের জীবনের অনেক ক্ষেত্র থেকে তাঁর শিক্ষা নির্বাসন দিয়ে বিধর্মীদের শিক্ষা ও কৃষ্টি-কালচার গ্রহণ করেছি। ফলে বনী ইসরাঈলরা যেমন আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করে কাফের বাদশাহ বখতে নছরের হাতে পরাজিত ও লাঞ্ছিত হয়েছিল (সুরা বানী ইসরাইল আয়াত নং-৪-৭) আমাদেরও আজ সেই দশা হয়েছে। 

হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) জীবনের মানোন্নয়নের সাথে চরিত্র গঠনের উপর বেশী জোর দিয়েছেন। তাই একজন আদর্শ শিক্ষক তাঁর শিক্ষাদানসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে তাঁকে আদর্শ মানলে ইনশাআল্লাহ উত্তম মানের শিক্ষক হতে পারবেন বলে আমি মনে করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ মত একটি জীবন গড়ার তৌফিক দান করুন। (আমীন)

একজন আদর্শ শিক্ষকের চরিত্র বিবরণী

এভাবে বলা যেতে পারে। চরিত্র মানব জীবনের রাজমুকুট। চরিত্রহীন ব্যক্তি পশুর সমান। দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য। তাই আদর্শ শিক্ষক সুচরিত্রের গুণাবলী অর্জন ও চর্চায় কোন আপোষ করেন না। ঈমান, আমলে ছালেহ সম্পাদন, তাক্বওয়া, সত্যবাদিতা, সততা, আমানতদারী, ওয়াদা পালন, শালীনতা শিষ্টাচারিতা, ন্যায়পরায়ণতা, আত্মীয়তা, মেহমানদারী, মানবসেবা। 
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ, কর্তব্যপরায়ণতা, মিতব্যয়িতা, পরোপকারিতা, আত্মার পবিত্রতা, পরিচ্ছন্ন বেশভূষা ইত্যাদি সৎগুণ তার চরিত্রের ভূষণ। হালাল ভক্ষণ, ছোটদের স্নেহ, বড়দের কদর ও আলেমদের সম্মান ও হক প্রদানে তিনি আগুয়ান। পক্ষান্তরে শিরক, কুফর, নিফাক, বিদ‘আত, জাহিলিয়্যাত থেকে তিনি দূরে থাকেন। 

মিথ্যা বলা, প্রতারণা, যুলুম, অহংকার, হিংসা, কৃপণতা, অপব্যয়, ধূমপান, মাদকাসক্তি, ব্যভিচার, ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, নকলে সহযোগিতা, প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাৎ, সূদ-ঘুষ, হারামখোরি, যৌতুক, নির্যাতন, অলসতা, উদাসীনতা, কর্তব্যে অবহেলা, পার্থিব স্বার্থে দ্বীন বিক্রয় করা ইত্যাদি মন্দ স্বভাব-চরিত্র থেকে তিনি বেঁচে থাকেন। 

তার জানা আছে ক্বিয়ামতে চরিত্রই হবে মীযানে সবচেয়ে ভারী। তিনি এও জানেন যে, চরিত্র সবচেয়ে সুন্দর যার, ঈমান সবচেয়ে পূর্ণ তার। দুশ্চরিত্র লম্পট জান্নাতে যাবে না। কাজেই একজন আদর্শ শিক্ষক নিজে যেমন চরিত্র সুন্দর রাখতে চেষ্টা করেন। তেমনি তার শিক্ষার্থীদেরসহ অন্যদের চরিত্রও সুন্দর করতে চেষ্টা করেন। 

তিনি এ কথাও জানেন যে, যে আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসে, আল্লাহর জন্য ঘৃণা করে, আল্লাহর জন্য কাউকে কিছু দেয় এবং আল্লাহর জন্য দেয়া থেকে বিরত থাকে সে ঈমান পূর্ণ করে। কাজেই একজন আদর্শ শিক্ষক তার কথায় কাজে আল্লাহর উপর নির্ভর করেন। যারা আল্লাহর পথের পথিক ও সৈনিক আল্লাহর জন্য তিনি তাদের ভালোবাসেন। 

আর যারা আল্লাহর পথের বিরুদ্ধাচারী তাদের জন্য তার মনে আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষেই তীব্র ক্ষোভ জন্মে। তবে দোষ-গুণের সমন্বয়ে মানুষ। মানুষ হিসাবে একজন শিক্ষক শয়তানের ফেরেবে, নফসের তাড়নায় কিংবা দুষ্টমতিদের পাল্লায় মন্দ কিছু করে ফেলতে পারেন। সেক্ষেত্রে তিনি তওবা করে আল্লাহর পথে ফিরে এলে তাকে মন্দ ভাবা ঠিক হবে না।

একজন আদর্শ শিক্ষকের ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা

অন্য মানুষের সঙ্গে যে আচার-আচরণ করা হয় তাই ব্যবহার। সদ্ব্যবহার সচ্চরিত্রের অংশ। হাদীছে এসেছে, الْبِرُّ حُسْنُ الْخُلُقِ অর্থাৎ ‘সুন্দর ব্যবহারই সচ্চরিত্র। একজন ভাল শিক্ষক নিজের শিক্ষার্থীসহ অন্য কাউকে কষ্ট দেন না। শিক্ষার্থীদের পড়া বুঝিয়ে দিতে রাগ-ক্ষোভ প্রকাশ করেন না।
উচ্চ মেধার শিক্ষার্থী, স্বল্প মেধার শিক্ষার্থী, ধনীর দুলাল, গরীবের সন্তান, ক্ষমতাধর ও ক্ষমতাশূন্য সকলকে তিনি এক মনে করে শিক্ষা দেন। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান জৈন, পার্সীতে কোন ভেদাভেদ করেন না। শিক্ষার্থীরা তার সম্বন্ধে ভাবে, আমার শিক্ষক আমাকেই বেশী ভালোবাসেন।

শিক্ষার্থীদের কেউ যদি অসুস্থ ভোগে তাহলে তিনি তাকে দেখতে যাই। তাদের কারও আর্থিক সমস্যা থাকলে তা দূর করতে চেষ্টা করে দেন। বিদ্যা শিক্ষা সংক্রান্ত তাদের কোন কৌতূহল বা জিজ্ঞাসা থাকলে তা যথাসাধ্য মিটাতে চেষ্টা করেন। শিক্ষার্থীদের দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, আত্মিক ও ধর্মীয় বিকাশে নিজের মেধা ও যোগ্যতা যথাসাধ্য ব্যয় করেন। 

কেউ সাক্ষাৎ করতে এলে হাসিমুখে তার সাথে নম্র ভাষায় কথা বলেন। কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে বিলম্ব হেতু বিচলিত হন না, বরং ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেন। কারও প্রয়োজন পূরণে অক্ষম হ’লে বিনয়ের সঙ্গে নিজের অপারগতা প্রকাশ করেন। কারও বেয়াদবীর জন্য গালমন্দ করেন না। রূঢ় আচরণ ও কর্কশ ভাষায় কথা বলা থেকে দূরে থাকেন।

কেউ তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করলে তিনি তার সঙ্গে কোমল আচরণ করেন। এবং ধৈর্য ধরেন। স্ত্রী, মাতা-পিতা, সন্তানাদি, প্রতিবেশী, ও চেনা-অচেনা সকলের সাথে তিনি ভাল ব্যবহার করেন। কথা বললে বুদ্ধিদীপ্ত কথা বলেন। বাজে তামাশা কিংবা কারও মনে আঘাত লাগে এমন কথা বলা থেকে বিরত থাকেন। এমন কথা বলেন না যাতে ব্যক্তিত্ব খর্ব হয়। 

এবং মূর্খতা প্রকাশ পায়। তিনি খুব গুরুগম্ভীর নন, বরং সহজ-সরল। যে কেউ সহজেই তার সঙ্গে মিশতে পারে। নিজের কাজ নিজেই করেন, পারতপক্ষে অন্যের উপর নির্ভর করেন না। অসহায়, ইয়াতীম, বিধবা, রোগী ও অভাবী মানুষের প্রতি সর্বদা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের প্রতি দায়িত্ব পালনে কৃপণতা করেন না। আল্লাহর বান্দা হিসাবে সকলে ভাই ভাই হিসাবে মিলেমিশে বসবাস করেন।

আদর্শ শিক্ষকের সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ তোমরা জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস কর, যদি তোমরা না জানো’ (সুরা আম্বিয়া আয়াত নং-৭) তোমাদের জানা না থাকলে জ্ঞানীদের নিকটে তোমরা জিজ্ঞেস করবে। সুতরাং একজন আদর্শ শিক্ষককে সর্ববিদ্যাবিশারদ কিংবা তার বিষয়ে তাকে খুব জানাশোনা হ’তে হবে এমন নয়। তবে তাকে জ্ঞানচর্চা অব্যাহত রাখতে হয়। 

কি রকম হওয়া উচিত আদর্শ শিক্ষকের ভাষা 

একজন আদর্শ শিক্ষক উত্তম বা আদর্শ উচ্চারণে কথা বলেন। ঘরোয়া পরিবেশে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললেও জনসমক্ষে তিনি শুদ্ধ ভাষা ব্যবহার করেন। বিশেষত পাঠদান কালে তিনি শুদ্ধ ভাষার বাইরে ভুলেও যাওয়ার চেষ্টা করে না সেই দিকে সচরাচর খেয়াল রাখে। 

মার্জিত ও শুদ্ধ উচ্চারণ ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলায় ব্যাপক ভূমিকা বিশেষ রাখে। মাতৃভাষা ব্যতীত অন্য ভাষায় কথা বললে যথাসম্ভব শুদ্ধ ভাষা ব্যবহার চেষ্টা করে। এটাই হচ্ছে একজন আদর্শ শিক্ষকের ভাষা।

শিক্ষার্থীর চরিত্র ও মানস গঠনে একজন শিক্ষকের ভূমিকা

শিক্ষার্থীরা মাতা-পিতা ও পরিবারের আদর্শ যতখানি না অনুসরণ করে। তার থেকেও অনেক  বেশী বেশী অনুসরণ অনুকরণ করে শিক্ষককে। অবচেতন মনেই তাদের মাঝে এ মানসিকতা গড়ে ওঠে। ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন শিক্ষক কোন কিছু না বললেও শিক্ষার্থীদের মাঝে তার চারিত্রিক ও ব্যবহারিক প্রভাব আয়ত্ত করে। 

সেক্ষেত্রে শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের চারিত্রিক গুণাবলী ও আচার-আচরণ লক্ষ্য রাখলে এবং প্রয়োজনীয় হেদায়াত দিলে শিক্ষার্থীদের চরিত্র ও মনমানসিকতা আরও সুন্দরভাবে গড়ে ওঠা স্বাভাবিক। তিনি তাদের দ্বীনী আক্বীদা সংশোধন, ইবাদত-বন্দেগীতে আগ্রহ ও মানুষের সাথে মেলামেশায় পারদর্শী করে তোলেন। যারাই আত্মজীবনী লিখেছেন। 

তারাই কমবেশী এমন প্রভাবক শিক্ষকের কথা তুলে ধরেছেন। বিখ্যাত ইসলাম পোশার-প্রচারক ডাঃ জাকির নায়েক তার শিক্ষক উস্তাদ আহমাদ দিদাতের নাম তার অনেক লেকচারে বলে থাকেন। একজন আহমাদ দিদাত না। থাকলে হয়তো একজন ডাঃ জাকির নায়েকের দেখা মিলত না। 

তাই ইসলামী তরীকায় রাসূলের আদর্শে জীবনধারা গড়তে শিক্ষক শিক্ষার্থীর সম্মিলিত প্রচেষ্টা এখানে বিশেষভাবে কামনা করে। একজন আদর্শ শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের এসব নেতিবাচক আচরণ পরিহার করে সমাজ ও জনগণের কল্যাণে ইতিবাচক চিন্তা গ্রহণে ভূমিকা রাখেন।

শ্রেণীকক্ষে একজন আদর্শ শিক্ষকের পাঠদান কেমন হওয়া উচিত 

শ্রেণীকক্ষে একজন আদর্শ শিক্ষকের পাঠদান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই পাঠদানকে শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় ও মান সম্মত করতে পরিকল্পনা করা উচিত। একটা ক্লাস নেয়ার পর ক্লাসের উন্নয়ন যোগ্য দিক গুলো দিয়ে কাজ করা উচিত। সাধারণভাবে শিক্ষক ক্লাসে নিম্নোক্ত ধাপ গুলো মানা যেতে পারে সেই বিষয়গুলো নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ-
  • শিক্ষক শ্রেণী কক্ষে শ্রেণী বিন্যাস বৃদ্ধি করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করবেন।
  • পাঠ দানের সময় এক জায়গায় না দাঁড়িয়ে ঘুরে ফিরে শ্রেণির কার্যক্রম পরিচালনা ও পর্যবেক্ষণ করে থাকেন।
  • পাঠ দানের সময় শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। এবং প্রশ্ন করার সুযোগ করে দিতে হবে।
  • শিক্ষার্থীদের শিখনে কি ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারে। তা নির্ণয় করে দূরীকরণে চেষ্টা কর।
  • পাঠের শিখন ফল নির্ধারণ পূর্বক সঠিক পদ্ধতি ব্যবহার করে পাঠদান উপস্থাপন করে থাকে।
  • সহজ বোধ্য ও সহজ লভ্য উপযোগী উপকরণ ব্যবহার করবেন।
  • জোড়ায় কাজ বা দলীয় কাজ দিয়ে শিক্ষার্থীদের কর্ম তৎপর রাখতে হবে।
  • সামনে পিছনে ডানে বামে সব শিক্ষার্থীদের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে।
  • শিক্ষার্থীদের উৎসাহ,প্রেরণা,মটিভ করার মধ্য দিয়ে শ্রেণী শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে।
  • শ্রেণীতে জেন্ডার বান্ধব পরিবেশ বজায় রাখতে হবে।
  • শিক্ষার্থীদের অনাকাঙ্খিত আচরণ নিয়ন্ত্রণে কঠিন মনোভাব পোষণ করতে হবে।
  • শিক্ষককে নিজের বক্তব্য সহজ সরল সাবলীল ভাষায় প্রকাশ করতে হবে।
  • শিক্ষককে শুনার মন মানসিকতা অবশ্যই থাকতে হবে।
যারা শিক্ষাগ্রহণ করে তারা শিক্ষার্থী বা ছাত্র। শিক্ষা একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শিক্ষা চলমান। যে কোন নতুন ও পরিবর্তিত পরিস্থিতে খাপ খাওয়ানোর কাজে শিক্ষা সাহায্য করে। আর মানুষকে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন পরিস্থিতির মুকাবেলা করতে হয়। কাজেই শিক্ষা তার প্রতিদিনই দরকার। একজন শ্রেণীশিক্ষক তার ছাত্রকে সেই নতুন পরিস্থিতি মুকাবেলার যোগ্য করে গড়ে তোলেন। 

আমাদের পাঠে সমস্যা হলে আদর্শ শিক্ষকের ভূমিকা

শ্রেণীকক্ষে কিংবা বাইরে পঠন-পাঠনে আমাদের কিছু মৌলিক সমস্যা রয়েছে। ভাষা শিক্ষা, কুরআন, হাদীছ ও ফিক্বাহর বিধান হাতে কলমে তথা ব্যবহারিকভাবে করে দেখানো, বিজ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, কম্পিউটারের ব্যবহার ইত্যাদি ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা ও উদাসীনতা চোখে পড়ার মত।

 আরবী ইংরেজী ভাষার পারদর্শিতা দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। শিক্ষাকর্তৃপক্ষ মাদ্রাসা শিক্ষাকে জেনারেল শিক্ষার সমান করার মানসে আরবী ভাষাকে গুরুত্বহীন করে দিয়েছে। যদিও প্রতি ক্লাসে আরবী বই আছে কিন্তু আরবী বলা, পড়া, লেখা ও বুঝার মত শিক্ষার্থী খুব কমই তৈরি হচ্ছে। 

ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কুরআন, হাদীছ ও ফিক্বাহ-এর বই-পুস্তক সরাসরি আরবী থেকে পড়া ও পড়ানোর যোগ্যতা তৈরি হচ্ছে না। কুরআন, হাদীছ ও ফিক্বাহ-এর যে ব্যবহারিক শিক্ষা আছে এবং শিক্ষার্থীদের তা শেখানো প্রয়োজন আমরা মনে হয় তা ভুলেই দিয়েছি।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,إِنَّمَا جُعِلَ الإِمَامُ لِيُؤْتَمَّ بِهِ فَإِذَا كَبَّرَ فَكَبِّرُوْا وَلاَ تُكَبِّرُوْا حَتَّى يُكَبِّرَ وَإِذَا رَكَعَ فَارْكَعُوْا وَلاَ تَرْكَعُوْا حَتَّى يَرْكَعَ وَإِذَا قَالَ سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَهُ فَقُوْلُوْا اللَّهُمَّ رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ. قَالَ مُسْلِمٌ وَلَكَ الْحَمْدُ. وَإِذَا سَجَدَ فَاسْجُدُوْا وَلاَ تَسْجُدُوْا حَتَّى يَسْجُدَ وَإِذَا صَلَّى قَائِمًا فَصَلُّوْا قِيَامًا وَإِذَا صَلَّى قَاعِدًا فَصَلُّوْا قُعُوْدًا أَجْمَعُوْنَ. ‘ইমাম কেবল এজন্যই যে, তার অনুসরণ করতে হয়। সুতরাং সে যখন তাকবীর বলবে তোমরাও তখন তাকবীর বলবে। 

তার তাকবীর না বলা পর্যন্ত তোমরা তাকবীর বলবে না। আর সে যখন রুকূ‘ করবে তোমরাও তখন রুকূ‘ করবে। তার রুকূ‘ না করা পর্যন্ত তোমরা রুকূ‘ করবে না। ইমাম ‘সামিআল্লাহু লিমান হামিদাহ’ বললে তোমরা বলবে, ‘আল্লাহুম্মা রববানা লাকাল হামদ’। মুসলিমের বর্ণনায় রয়েছে, ‘ওয়া লাকাল হামদ’। আর ইমাম যখন সিজদা করবে তোমরাও তখন সিজদা করবে। তার সিজদা না করা পর্যন্ত তোমরা সিজদা করবে না।

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ বলেছেন,أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّىْ إِمَامُكُمْ فَلاَ تَسْبِقُوْنِىْ بِالرُّكُوْعِ وَلاَ بِالسُّجُوْدِ وَلاَ بِالْقِيَامِ وَلاَ بِالاِنْصِرَافِ হে লোক সকল! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের ইমাম। সুতরাং তোমরা আমার আগে চলে যেও না, না রুকূতে, না সিজদায়, না ওঠায়, না বসায়, না সালাম ফিরানোতে।

বারা বিন আযিব (রাঃ) বলেন, كُنَّا نُصَلِّى خَلْفَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَإِذَا قَالَ سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَهُ. لَمْ يَحْنِ أَحَدٌ مِنَّا ظَهْرَهُ حَتَّى يَضَعَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم جَبْهَتَهُ عَلَى الأَرْضِ আমরা নবী করীম (সাঃ) এর পিছনে ছালাতে দাঁড়াতাম। তিনি যখন দাঁড়ানো অবস্থা থেকে সিজদার জন্য ঝুঁকতেন তখন তাঁর কপাল যমীনে না রাখা পর্যন্ত আমাদের একজনও তার পিঠ নোয়াত না। 

দুই সিজদার মাঝের দো‘আ অধিকাংশ ইমাম-মুক্তাদী পড়েন না। পড়লে যারা পড়েন তাদের পড়তে সমস্যা হতো না। সালামও তারা ইমামের সাথেই ফিরান, অথচ ইমামের সালাম ফিরানোর পর তাদের সালাম ফিরানোর কথা। 

সূরা, দোআ-দরূদ বলতে গেলে অধিকাংশ মুছল্লীর শুদ্ধ হয় না। মাদ্রাসায় যদি ছালাতের নিয়মিত তা‘লীম-তারবিয়াতের ব্যবস্থা থাকত আর ইমামগণ মুছল্লীদের তা শিখাতেন তাহলে ছালাতের এরকম দুর্দশা কখনোই হতো না বলে আমি মনে করি।

পাঠদান বা শ্রেণী কক্ষের বাইরে আদর্শ শিক্ষকের ভূমিকা

আমরা অবশ্যই জানি মানুষ মাত্রেই সামাজিক জীব। শিক্ষকও মানুষ। কাজেই তাকে সমাজের মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে হয়। একজন ভাল শিক্ষক প্রথমেই তার পরিবারের কথা ভাবেন। পরিবারের সদস্যদের দ্বীন শেখানো, দ্বীনের উপর চালানো, আদব-কায়দা ও ভদ্রতা শেখানো, সামাজিক নিয়ম-নীতি সম্পর্কে বুঝানোর বিষয়ে তিনি সদাই সর্বদা সজাগ থাকে।

সমাজের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার অধ্যয়ন থাকে। তিনি সমাজে ভাল কাজের প্রসার এবং মন্দ কাজের নিষেধে সচেষ্ট থাকেন। সমাজের নানা প্রতিষ্ঠান যেমন শিক্ষালয়, মসজিদ, মাদ্রাসা, মৃত্যু-জানাযা, বিয়ে-শাদী ইত্যাদির সাথে জড়িত থাকেন। নানা সামাজিক কাজে তিনি নিজ থেকে এগিয়ে যান কিংবা ডাকলেই তাকে পাওয়া যায়। 

সামাজিক কোন প্রতিষ্ঠান গড়ার প্রয়োজন পড়লে সেখানে তার ভূমিকা থাকে। জামা‘আতবদ্ধ যিন্দেগী যাপন ও সমাজের মানুষগুলোর দ্বীনী চেতনা তৈরিতে তিনি শ্রম ব্যয় করেন। তিনি সমাজের অসহায়, ইয়াতীম, বিধবা, অসুস্থ ও দুস্থ মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা ও সেবা-যত্ন করেন।

শেষকথাঃ

প্রিয় পাঠক আজকের আর্টিকেলটি ছিল আদর্শ শিক্ষক বিষয় নিয়ে। আমরা আদর্শ শিক্ষকের যে গুণাবলী এবং দায়িত্ব-কর্তব্য বলেছি তাও চূড়ান্ত কিছু নয়। অনেক শিক্ষকের মধ্যে এর থেকেও অনেক বেশী গুণ থাকতে পারে। আবার অনেকের মধ্যে এসব গুণ কম মাত্রায়ও থাকতে পারে। মোটকথা সাধ্যমত দ্বীনদারী ও সততার সঙ্গে ব্যক্তিগত, 

পারিবারিক, সামাজিক ও পেশাগত দায়িত্ব পালনকারী শিক্ষককে একজন আদর্শ শিক্ষক বলা যেতে পারে। আল্লাহ এই ব্যাপারে বলেন, لَا يُكَلِّفُ اللهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا ‘আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত কাজে বাধ্য করেন না। (সুরা বাক্বারাহ আয়াত নং-২৮৬) 

আল্লাহ পাক আমাদের সবাই কে সুন্দর আখলাক এবং একজন ভালো শিক্ষক হিসাবে ছাত্রদের পাঠদানে বিশেষ ভূমিকা রাখা তৌফিক দান করুন। তার সাথে সাথেই আপনাদের সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করে আজকের মত আর্টিকেলটি লিখা ইতি করছি। আল্লাহ হাফেজ

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন