পিতা-মাতার হকের গুরুত্ব কোরআন হাদিসের আলোকে বিস্তারিত জানুন
কোরআন ও হাদিসের আলোকেপিতা-মাতার হক সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়। পিতা-মাতা হলেন
সন্তানের জীবনের ভিত্তি। তাদের স্নেহ, ভালোবাসা,
এবং ত্যাগের মধ্যেই সন্তানের জন্ম ও বিকাশ ঘটে। ধর্ম সমাজ ও মানবিক মূল্যবোধের
দৃষ্টিকোণ থেকে পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইসলাম ধর্মে এই দায়িত্বকে অত্যন্ত গুরুতর বলে গণ্য করা হয়েছে। এবং কোরআন-হাদিসে
পিতা-মাতার অধিকার সম্পর্কে বহু নির্দেশনা রয়েছে। আমাদের পার্থিব জীবনের পাশাপাশি
আখিরাতেও এই দায়িত্বের প্রভাব রয়েছে।
তাই পিতা-মাতার প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা প্রদর্শন করা, তাদের সেবা করা, এবং তাদের
সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি যত্নশীল হওয়া একজন সন্তানের জীবনের অন্যতম প্রধান
কর্তব্য।
তাই এই বিষয় নিয়ে কোরআন ও হাদিস থেকে কিছু আলোচনা করব যা আমার এবং আপনাদের জীবন
দশায় অনেক উপকারে আসবেন। তাহলে চলুন বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।
কনটেন্ট সূচিপত্রঃ- পিতা-মাতার হকের গুরুত্ব কোরআন হাদিসের আলোকে বিস্তারিত
পিতা-মাতার হক একটি পূর্ণাঙ্গ আলোচনা
পিতা-মাতা আমাদের জীবনের সর্বপ্রথম শিক্ষাগুরু। ইসলাম ধর্মে পিতা-মাতার প্রতি
সন্তানের দায়িত্বকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে। কোরআন ও হাদিসে
পিতা-মাতার হক সম্পর্কে বারংবার আলোচনা এসেছে, যা সন্তানের প্রতি তাঁদের অধিকারের
ব্যাপারে আমাদের সচেতন করে।
পিতা-মাতার হকের গুরুত্ব
পিতা-মাতা আমাদের জন্ম দিয়েছেন, লালন-পালন করেছেন এবং আমাদের মানুষ হিসেবে গড়ে
তোলার জন্য প্রচুর কষ্ট করেছেন। ইসলাম এই অবদানের মূল্যায়ন করে এবং সন্তানের
প্রতি পিতা-মাতার হক পালনকে বাধ্যতামূলক করে তোলে। হাদিসে এসেছে, "আল্লাহ
সন্তুষ্ট হন পিতা-মাতার সন্তুষ্টির মাধ্যমে, এবং আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন পিতা-মাতার
অসন্তুষ্টির মাধ্যমে।" (তিরমিজি)
পিতা-মাতার হকসমূহ
সম্মান ও ভক্তি প্রদর্শন করা
পিতা-মাতার সাথে নম্র, ভদ্র এবং সম্মানজনক ব্যবহার করতে হবে। কোরআনে আল্লাহ বলেন,
"তোমার রব আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না। এবং পিতা-মাতার
প্রতি সদাচার করো। তাদের একজন বা উভয়েই যদি তোমার জীবনে বৃদ্ধাবস্থায় উপনীত হন,
তবে তাদের ‘উফ’ বলো না এবং তাদের ধমক দিও না।" (সূরা বনি ইসরাঈল, আয়াত ২৩)
খেদমত ও যত্ন করা
বিশেষ করে বৃদ্ধ বয়সে তাদের সেবাযত্ন করা সন্তানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ
দায়িত্ব। এ সময় তাদের দেহ দুর্বল ও চাহিদাগুলো বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে।
পিতা-মাতার খেদমতে তাদের প্রত্যাশার চেয়ে বেশি আন্তরিকতা প্রদর্শন করতে হবে।
অর্থনৈতিক সহায়তা করা
পিতা-মাতা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল বা নির্ভরশীল হলে তাদের প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা
করা সন্তানের দায়িত্ব। সন্তান নিজের অর্থ-সম্পদ থেকে পিতা-মাতার সহায়তায় উদারতা
প্রদর্শন করতে পারে।
দোয়া করা ও পরকালীন কল্যাণ কামনা করা
কোরআন ও হাদিসে দোয়া করার মাধ্যমে পিতা-মাতার জন্য কল্যাণ কামনা করার বিষয়ে
গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন, "বল, হে আমার প্রভু! তাদের উপর দয়া করো,
যেভাবে তারা শৈশবে আমাকে লালন করেছেন।" (সূরা বনি ইসরাঈল, আয়াত ২৪)
পিতা-মাতার বন্ধুদের সম্মান করা
হাদিসে এসেছে যে, সন্তানের পিতা-মাতার জীবিত বন্ধুদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনও
ইসলামের একটি নির্দেশ। এতে বোঝা যায় যে, ইসলাম শুধু পিতা-মাতাকেই নয়, বরং তাদের
সামাজিক সম্পর্কগুলোকেও সম্মানের মধ্যে রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
পিতা-মাতার হক আদায় না করার পরিণাম
পিতা-মাতার হক পালনে অবহেলা করলে তার মারাত্মক পরিণাম হতে পারে। রাসূল (সা.)
বলেছেন, "তিন ধরনের ব্যক্তির জন্য আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন:
মদ্যপানকারী, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান এবং ব্যভিচারকারী।" (নাসাঈ)
ইসলামে পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্বকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়।
পিতা-মাতার হক পালন শুধু ধর্মীয় বিষয় নয়, বরং তা সন্তানের নৈতিক দায়িত্বও বটে।
তাই, আমরা যেন সর্বদা তাঁদের সম্মান, সেবা এবং খেদমতে নিজেদের নিয়োজিত রাখি, এবং
তাদের সন্তুষ্টির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করি।
পিতা মাতার হক সম্পর্কে আয়াত
কোরআনে পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন স্থানে স্পষ্ট
নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আয়াত উল্লেখ করা হলো, যা
পিতা-মাতার হক সম্পর্কে আমাদের বুঝতে সাহায্য করবে
- তোমার প্রভু আদেশ করেছেন, তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদের 'উফ' বলো না।
- আমরা মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে গর্ভে ধারণ করেছে এবং দুই বছরে তার দুধ ছাড়ানো হয়। সুতরাং তুমি আমার প্রতি এবং তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। আমার কাছেই ফিরে আসবে। (সুরা লুকমান আয়াত ১৪)
- আমি মানুষকে পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। যদি তারা এমন কিছু করতে বাধ্য করে যা তুমি জান না (শিরক), তবে তাদের কথা মানবে না। আমারই দিকে তোমাদের প্রত্যাবর্তন এবং আমি তোমাদের জানিয়ে দেব যা তোমরা করতে। (সুরা আনকাবুত আয়াত ৮)
- আল্লাহর ইবাদত করো, এবং তার সাথে কোনো কিছুকে শরিক করো না। পিতা-মাতার প্রতি সদয় হও। এবং আত্মীয়-স্বজন, এতিম, মিসকিন নিকটবর্তী প্রতিবেশী, দূরবর্তী প্রতিবেশী, পাশে বসা বন্ধু, পথচারী ও তোমার অধিকারভুক্ত দাসদের প্রতি। আল্লাহ অহংকারীকে এবং গর্বিত ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না। (সুরা আন-নিসা, আয়াত ৩৬)
এই আয়াতগুলোতে দেখা যায় যে, পিতা-মাতার প্রতি সম্মান, কৃতজ্ঞতা এবং সেবার বিষয়ে
কোরআন অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছে। ইসলামের শিক্ষায় পিতা-মাতার খেদমত, তাদের
সেবা, ও তাদের প্রতি দায়িত্ব পালনকে আল্লাহর ইবাদতের অংশ হিসেবে গণ্য করা
হয়েছে।
পিতা-মাতার হক সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসের আলোকে
ইসলামে পিতা-মাতার অধিকারকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। কোরআন
ও হাদিসে তাদের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও আচরণ সম্পর্কিত অনেক নির্দেশনা
রয়েছে। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আয়াত ও হাদিস উল্লেখ করা হলো।
- তোমার প্রভু আদেশ করেছেন, তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদের 'উফ' বলো না এবং তাদের ধমক দিও না, আর তাদের সঙ্গে সদ্ভাবপূর্ণ কথা বলো। তাদের প্রতি বিনয়ের ডানা বিস্তার করো এবং বলো, ‘হে আমার প্রভু! তাদের প্রতি দয়া করো, যেমন তারা শৈশবে আমাকে লালন করেছেন। (সুরা আল-ইসরা, আয়াত ২৩-২৪)
- আমরা মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে গর্ভে ধারণ করেছেন এবং দুই বছরে তার দুধ ছাড়ানো হয়েছে। সুতরাং তুমি আমার প্রতি এবং তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। আমার কাছেই তোমাদের ফিরে আসতে হবে।" (সুরা লুকমান, আয়াত ১৪)
- আল্লাহর ইবাদত করো এবং তার সাথে কোনো কিছুকে শরিক করো না। পিতা-মাতার প্রতি সদয় হও এবং আত্মীয়-স্বজন, এতিম, মিসকিন, নিকটবর্তী প্রতিবেশী, দূরবর্তী প্রতিবেশী, পাশে বসা বন্ধু, পথচারী ও তোমার অধিকারভুক্ত দাসদের প্রতি সদ্ব্যবহার করো। আল্লাহ অহংকারীকে এবং গর্বিত ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না।" (সুরা আন-নিসা, আয়াত ৩৬)
পিতা মাতার হক সম্পর্কে হাদিস
পিতা-মাতার সেবার ফজিলত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "পিতা-মাতার সন্তুষ্টিতে
আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পিতা-মাতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি।"
(তিরমিজি)
জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ধিক ঐ ব্যক্তির প্রতি,
যার পিতা-মাতা অথবা তাদের একজন তার জীবনে বার্ধক্যে উপনীত হয়। আর তখনও সে
জান্নাত লাভ করতে পারে না। (মুসলিম)
পিতা-মাতার জন্য দোয়া করা হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত,
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতার জন্য দোয়া করবে,
আল্লাহ তাকে তার দোয়াতে বরকত দেবেন।" (তিরমিজি)
সন্তানের কর্তব্য এক সাহাবি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন,
"হে আল্লাহর রাসুল, মানুষের মধ্যে আমার ভাল ব্যবহারের সবচেয়ে বেশি অধিকারী
কে?" রাসুলুল্লাহ (সা.) উত্তর দিলেন, "তোমার মাতা।
সাহাবি আবার প্রশ্ন করলেন, "তারপর কে তিনি বললেন, তোমার মাতা। সাহাবি পুনরায়
জিজ্ঞাসা করলেন, তারপর কে? তিনি আবার বললেন, "তোমার মাতা।সাহাবি আবার বললেন,
"তারপর কে?" রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, "তোমার পিতা।" (বুখারি ও মুসলিম)
উপরে বর্ণিত কোরআন ও হাদিসের আলোকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, পিতা-মাতার প্রতি
সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পালনীয়। তাদের
প্রতি সম্মান, দোয়া এবং সেবার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব।
সর্বশেষ কথা
পিতা-মাতার হক আদায় ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, যা কেবল ধর্মীয়
দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, মানবিক দায়িত্ব হিসেবেও পালনীয়। কোরআন ও হাদিসে
পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্বকে বারবার গুরুত্বসহকারে তুলে ধরা
হয়েছে।
তাদের প্রতি সম্মান, খেদমত এবং ভালোবাসা প্রদর্শন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের
অন্যতম উপায়। বিশেষত, তাদের বার্ধক্যে যত্ন নেওয়া এবং দোয়া করা সন্তানের জন্য
একটি মহান কর্তব্য। পিতা-মাতার প্রতি সঠিক দায়িত্ব পালন না করলে,
আখিরাতে তার কঠিন প্রতিফল হতে পারে। তাই আমাদের উচিত সর্বদা তাদের সঙ্গে সদাচরণ
করা এবং তাদের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত রাখা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই দায়িত্ব
পালন করার তৌফিক দান করুন। আমিন।